স্থপতি ইকবাল হাবিব। নগর পরিকল্পনাবিদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক। জন্ম ১৯৬৩ সালে। পড়াশোনা করেছেন বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যায়। ঢাকার হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেক, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্স, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের অন্যতম ডিজাইনার। এছাড়া পরিবেশ ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন দীর্ঘকাল।
রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে হতাহতের ঘটনা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু
ইকবাল হাবিব: আমি প্রথম থেকেই বলে এসেছি, এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। গার্ডারচাপায় হত্যাকাণ্ডে মূলত দুর্নীতি জড়িত।
ইকবাল হাবিব: এ ধরনের সব প্রকল্পে প্রাক-সমীক্ষা এবং সে সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প প্রণয়ন করতে হয়। এই প্রকল্পের প্রাক-সমীক্ষা যথাযথভাবে করা হয়নি। যেখানে পরিবেশ-প্রতিবেশ সমন্বিত রাখার জন্য পরিকল্পনা ও কৌশল লেখা থাকে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য প্রকল্পের মতো জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য বিকল্প রাখা হয় এবং এর জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। একই সঙ্গে জননিরাপত্তার জন্যও অর্থ বরাদ্দ থাকে। দশ বছর ধরে এসব প্রকল্পে এই অর্থের আদৌ কোনো ব্যবহার হয়েছে কি না, তার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।
এই অর্থ তছরূপ বা দুর্নীতি হয়েছে বলে আমি মনে করি। তৃতীয়ত, এ ঘটনা পঞ্চমতম ঘটনা। এর আগে আরও চারটি ঘটনার পরেও মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার মানে এই দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ও জড়িত। গত জুলাই মাসে এমন একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপরও মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তার মানে গার্ডারচাপায় হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রণালয়ও দায়ী।
ইকবাল হাবিব: ত্রুটি থাকলে সেখানে আবার নিরাপত্তা থাকে কীভাবে? আপনি এ ঘটনার ভিডিও দেখেন। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গাড়ি। লাইন করে বহু গাড়ি সেখানে পার্কিং করা ছিল। এই গাড়িগুলো সরিয়ে দেওয়া, চলাচল বন্ধ করা এবং এভাবে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল ট্রাফিক পুলিশের। কারণ সড়কের দায়িত্বে পুলিশ থাকে। পুলিশ এ ঘটনায় দায় এড়াতে পারে না। সবকিছু মিলে এটি একটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।
অপরাধের বিপরীতে দায়মুক্তির প্রবণতা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। এই অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়ার অপরাধগুলো পরম্পরায় ঘটছে এবং মৃত্যুর মতো ঘটনা সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে মিটিয়ে ফেলা হচ্ছে। আরেকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড মানুষ ভুলে যাবে এবং এটি একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামে গার্ডার পড়ে ২৯ জন মানুষ মারা গেলো। আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি।
ইকবাল হাবিব: আমি কিন্তু এখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করিনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তো অবশ্যই দায়ী হবে এখানে। ক্রেনমাস্টার দায়ী হবে। যারা জড়িত সবাই দায়ী হবে।
কিন্তু এর মধ্যে আটকে থাকলে হবে না। আমি আগে যে চারটি পয়েন্টের কথা উল্লেখ করলাম, তা আমলে নিতে হবে। বারবার দুর্ঘটনার পরেও নিরাপত্তার ঘাটতি হবে কেন? তিন বছরের প্রজেক্ট কেন দশ বছরেও শেষ হবে না? প্রকল্পের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ-প্রতিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার মূল্যায়ন কে করবে?
ইকবাল হাবিব: সরকার যা করছে, তা টেকসই উন্নয়ন নয়। উন্নয়নের নামে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হলো তার হিসাব নেওয়ার সক্ষমতাও নেই। মানুষের তো ক্ষতি হলো। অর্থের ক্ষতি, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির তো মূল্যায়ন করা যায়। এর সঠিক মূল্যায়ন করলে এসব উন্নয়ন আর হবে না। এ কারণেই করে না।
ইকবাল হাবিব: জবাবদিহি শুধু সংস্কৃতির ব্যাপার বললে ভুল হবে। আইন দ্বারা সংরক্ষিত। জবাবদিহি না করলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। শাস্তি হবে। কিন্তু হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, যে সাজা দেবে আর যে সাজা পাবে তারা দু’পক্ষ মিলেমিশে একাকার। তখন আর আইন সেখানে গুরুত্ব পাবে না।
আমি মনে করি, মন্ত্রণালয় থেকে যদি দায়বদ্ধতার প্রশ্নের সঠিক উত্তর বের করা না যায়, তাহলে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে না। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক। মন্ত্রীও গার্ডারচাপায় হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না।
ইকবাল হাবিব: এজন্য আমি বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা বলে আসছি। যাকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে, তিনিই এই প্রকল্পের তদারকি কমিটির সভাপতি। আপাতদৃষ্টিতে তিনি অভিযুক্ত। অথচ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এই হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি।
ইকবাল হাবিব: আপনি যদি একটি উন্নয়নকে টেকসই হিসেবে দেখাতে চান, তাহলে আগে মূল্যায়ন করতে হবে এখানে কতজন মানুষকে আপনি সেবার আওতায় আনতে পারবেন। আপনি যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছেন, তার সুবিধা আসলে পাবে কারা? এটি বাংলাদেশে বিচার-বিবেচনা করা হচ্ছে না।
মেয়রদের কাছ থেকে গল্প ছাড়া আপনি আর কী শুনতে পেলেন? আনিসুল হকের মৃত্যুর পর দৃশ্যমান আর কী পরিবর্তন হয়েছে? অনেক গল্প তো শোনালেন। কী করতে পারলেন?
আমরা আসলে গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিমালা থেকে বের হতে চাই না। সামষ্টিক নীতিমালা গুরুত্ব পেলে এই হাল হওয়ার কথা নয়। এ কারণেই আমাদের উন্নয়নকে সার্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ইকবাল হাবিব: উন্নয়নের নামে রাজধানীকে সমাধানহীন গন্তব্যে ঠেলে দিচ্ছে। ইতিহাস দেখেন। সিঙ্গাপুর, মাদ্রিদ, দিল্লি, বোম্বে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে আবার গড়েছে। এর জন্য সাহস লাগে। রাজনৈতিক শক্তি লাগে। জনবান্ধব আমলাতন্ত্র লাগে।
সবাইকে নিয়ে উন্নয়ন করার মানসিকতা জন্ম নিলেই সত্যিকার উন্নয়ন হবে। আমরা ঢাকায় তা করতে পারিনি। যদিও হাতিরঝিল প্রকল্প করে জনবান্ধব উন্নয়নের উদাহরণ সৃষ্টি করা গেছে। এরপর আপনি আর টেকসই উন্নয়নের নজির দেখতে পাবেন না। সুতরাং ঢাকা বাঁচবে না মরবে তা সময়ই বলে দেবে।