আগামী সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দলের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি।
তিনি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন আরও ১৮ মাস পরে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ যৌথ কমিশনের বৈঠকে সরকারের সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছে। তবে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দলের বিষয়ে আমার উত্তর হচ্ছে, আমি কিছু জানি না।
শনিবার (১৬ জুলাই) রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কোনো পর্যবেক্ষক দল থাকবে কি না, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের এমন প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি।
তিন পর্বের এ অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে ছিল রাষ্ট্রদূতের বক্তৃতা, দ্বিতীয় অংশে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একটি আলোচনা পর্ব- যেখানে সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষ অংশে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। যেখানে আমন্ত্রিত সাংবাদিকরা সরাসরি রাষ্ট্রদূতকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন। এসময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক আছে সেটির জন্য আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর পেছনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভবিষ্যতেও এ ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি তার বক্তব্যে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাঠামোগতভাবে জটিল হলেও এর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে গঠনমূলক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখাই এর মূল উদ্দেশ্য। শুধু সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়ানোই নয়, একই সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শক্তিশালী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি করাও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্দেশ্য।
‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, সুশাসন ও গণতন্ত্র, সামরিক সহায়তা, শান্তিরক্ষা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এছাড়াও সদস্য রাষ্ট্র ব্যতীত বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।’
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে দেখতে চান, সিজিএজের নির্বাহী পরিচালকের এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, আগামী ১০ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে চায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এরই মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হয়েছে। আগামী ১০ বছর বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি।
চার্লস হোয়াইটলি বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বাজারকে এর সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ইচ্ছুক।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট নিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও শরণার্থী সংকট রয়েছে। তাই আমরা জানি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া কতটা ব্যয়বহুল হতে পারে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পক্ষ থেকে যতটুকু করার সেটা করবে। এজন্য ভারত, চীনের মতো আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশগুলোকে এক ছাদের নিচে আনতে হবে। মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কূটনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করছে। ইউরোপে আর কোনো যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটুক সেটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় না।
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে কি না জানতে চাইলে হোয়াইটলি বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। একই সঙ্গে চীনও বিশ্বে একটি পরাশক্তি হয়ে উঠেছে। চীনের সঙ্গে কিছু বিষয়ে আদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশি পোশাক শিল্পের স্থানীয় ব্র্যান্ড তৈরিতে কখনো আগ্রহ প্রকাশ করবে কি না- অ্যাম্বাসেডর নাসিম ফেরদৌসের এমন প্রশ্নের জবাবে চার্লস হোয়াইটলি বলেন, এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিজিএমইএ একটি পরিকল্পনা আছে। তবে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত নির্মাণ শিল্পে তাদের আগ্রহ বেশি।
ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের তরুণদের অপার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো তারা কাজে লাগাতে চান। একই সঙ্গে পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে প্রযুক্তিখাতে প্রশিক্ষণের পরিমাণ বাড়াতে চায়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্যক্রমের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্ষেত্রে বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি করছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্তব্য করার কোনো অধিকার নেই’ সরকারের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করবো না। তবে বাংলাদেশের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো বিশেষ বিনিয়োগ করছে কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, স্বাস্থ্যখাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মসূচি সীমিত আকারে রয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বেশকিছু কর্মসূচি তারা হাতে নিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে প্রযুক্তিবিদ্যার ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশের পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি পর্যটন শিল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানো যায়, তাহলে বাংলাদেশ বিদেশি পর্যটকদের জন্য একটি অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠবে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর জোর না দিয়ে তিনি মানব উন্নয়নের ওপর কাজ করতে বলেন।