যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দীর্ঘ ৭০ বছর শাসনের চার দিনব্যাপী প্লাটিনাম জুবিলি (উৎসব) পালনের পরদিনই অর্থাৎ ৬ জুন অনুষ্ঠিত এক শ্বাসরুদ্ধকর ও উত্তেজনাপূর্ণ আস্থা ভোটে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানিসংকট ও বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আকস্মিকভাবে এক অনাস্থা প্রস্তাব আনেন তাঁর নিজ রক্ষণশীল (কনজারভেটিভ) দলের পার্লামেন্ট সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিরুদ্ধে সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, করোনা অতিমারির সময়ে দেশ যখন ধুঁকছিল, তখন রাতের অন্ধকারে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মদের পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।
জ্বালানিসংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিকরা যখন বিপর্যস্তভাবে জীবনযাপন করছে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তখন একের পর এক মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে গেছেন। তা ছাড়া সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে তাঁর রয়েছে চরম অবহেলা। এমন একজন ‘অসৎ ও মিথ্যাবাদী’ নেতার অধীনে কিংবা নেতৃত্বে আগামী ২০২৪ সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জয়লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। সেসব কারণে দলের ভেতরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের কোন্দল দিন দিনই নীতি-নৈতিকতাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সেসব অভিযোগ খণ্ডন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে করোনা অতিমারির সময় রাতে পার্টির আয়োজন করার কারণে তিনি সংসদ ও জাতির কাছে একাধিকবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। বলেছেন, করোনা অতিমারি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাঁর সরকারের কোনো অবহেলা ছিল না। সে ক্ষেত্রে ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে। বিদায়ি শীতে সাধারণ মানুষের আবাসিক জ্বালানি চাহিদা মেটানোর ব্যাপারে বিশেষভাবে সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মোকাবেলায় সরকার এরই মধ্যে ৯৫ বিলিয়ন পাউন্ডের সহায়তা ঘোষণা করেছে। এতে প্রতিটি দরিদ্র পরিবার, পেনশনভোগী ও প্রতিবন্ধীরা নির্দিষ্ট হারে সহায়তা পাবে এবং তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রুশ আক্রমণ থেকে নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার ইউক্রেনকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমরাস্ত্র সাহায্য দিয়েছে এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। চলমান সংঘর্ষকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকি নিয়ে কিয়েভ সফর করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিরুদ্ধে মূল দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের ভিত্তি অন্যত্র প্রোথিত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে তাঁর নিজ দলের অভ্যন্তরে। এই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের কোন্দল বলে প্রচার করা হয়েছে। সেই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শঙ্কিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষ থেকে ইউক্রেন সংকটে অনেক কাজেই নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আগামী ব্রিটিশ সংসদীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকের কাছে সেটিও একটি বিশেষ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। সে কারণেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বরিস জনসনকে ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন অনেকে। সক্রিয় হয়েছে স্বার্থান্বেষী মহল। এ অভিযোগ বরিস শিবিরের।
উপরোল্লিখিত এই দলীয় দ্বন্দ্ব কিংবা সংঘাত বহুদিন ধরেই জারি রয়েছে। রক্ষণশীল দলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের পদত্যাগকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালের মধ্যভাগ থেকে বরিস জনসনের সঙ্গে দলের, বিশেষ করে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেরেমি হান্টের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদসহ আরো অনেকে যুক্ত ছিলেন। বরিস জনসন ওই সময় পদত্যাগ করার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ব্রেক্সিট প্রশ্নে অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আসার দাবিতে তখন এক পর্যায়ে পদত্যাগ করে বরিস জনসন দলীয় নেতৃত্বের হাল ধরতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এতে বিরোধী দল লেবার পার্টি ছাড়াও নিজ দলে অসংখ্য প্রতিপক্ষ তৈরি করেছেন বরিস জনসন। তাঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ ষোলো আনাই ইইউতে থাকার পক্ষপাতী ছিলেন। সেই গোষ্ঠীর অনেকেই এ ব্যাপারে এখনো সোচ্চার রয়েছেন। বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি ২০২০ সালে ব্রেক্সিটের প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলেও ব্রেক্সিটভিত্তিক বিতর্ক ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এখনো শেষ হয়নি। সেগুলো এখন ডালপালা মেলে আরো অনেক বিস্তৃত হয়েছে। বরিস জনসনের বেপরোয়া স্বভাব ও অতি স্মার্ট চরিত্র তাঁর শত্রু শিবিরকে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত রক্ষণশীল দলের বেশ কিছু পার্লামেন্ট সদস্যের অনাস্থা প্রস্তাব।
বহুদিন ধরে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার গুঞ্জন থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্লাটিনাম জুবিলি পালনের শেষ ভাগে এসে দলের ৫৪ জন পার্লামেন্ট সদস্য ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যান স্যার গ্রাহাম ব্রাডির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি লিখে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। সেই হিসেবে সংসদীয় বিধান অনুযায়ীই তাত্ক্ষণিকভাবে অর্থাৎ ৬ জুন বরিস জনসনের নেতৃত্বের পক্ষে ও বিপক্ষে দলীয় সংসদ সদস্যদের ভোটাভুটি সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মোট ৬৫০ জন সদস্যের মধ্যে রক্ষণশীল দলীয় সদস্য রয়েছেন ৩৫৯ জন এবং লেবার দলীয় ১৯৯ জন। গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় ঘোষণা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলীয় সদস্যদের উদ্দেশে সম্মিলিতভাবে ভাষণ দেন। তখনো অনেকের ধারণা ছিল, জনপ্রিয়তা হারানো বরিস জনসন শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে বিদায় নেবেন। এ ধরনের ধারণা জন্ম নিয়েছিল গোপন ব্যালটের কারণে। বরিসবিরোধীরা জোরালোভাবে গণমাধ্যমে তাঁদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর ৩৫৯ জন রক্ষণশীল দলীয় পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটগ্রহণ চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। ৯টায় ফলাফল জানানো হবে বলে স্যার গ্রাহাম ব্রাডি উল্লেখ করেন। সে কী টান টান উত্তেজনা! ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্থ আয়ারল্যান্ডের অর্থাৎ সমগ্র যুক্তরাজ্যের জনজীবনের গতি, কর্মচাঞ্চল্য ও তৎপরতা যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়টির জন্য। চলমান ছিল শুধু গণমাধ্যমের প্রচার কার্যক্রম বা অনুষ্ঠানাদি। সবাই তখন ৯টার খবরের অপেক্ষায়। সেই অবস্থা যেন জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকেও হার মানিয়েছে।
বরিস জনসন একসময় নিজে একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখা কলাম ডেইলি টেলিগ্রাফ কিংবা লন্ডন টাইমসে মূলধারার পাঠকরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পাঠ করতেন। সেই থেকে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। লন্ডন মহানগরীর জনপ্রিয় মেয়র হিসেবে তিনি কাজ করেছেন ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। তারপর অংশ নেন রক্ষণশীল দলের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় নির্বাচনে এবং ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের অধীনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। শেষ পর্যন্ত ব্রেক্সিট প্রশ্নে বরিস পদত্যাগ করে দলীয় নেতৃত্ব অর্জনের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন বরিসকে অনেক সুযোগ এনে দিয়েছিল। তিনি ক্ষমতাসীন হয়ে তাঁর ব্রেক্সিটের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। পাশাপাশি প্রশাসনে আনেন ব্যাপক পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ব্যবস্থা। সেই সময় থেকে দলের ভেতরেও বিভিন্ন সংস্কার সাধনে তৎপর হয়ে ওঠেন বরিস। তাঁর সেই কর্মতৎপরতা বিশ্বমঞ্চে ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যকে যেমন দিয়েছে নতুন অবস্থান, তেমনি দেশ-বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপে সৃষ্টি করেছে এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। নিজ দেশে, বিশেষ করে নিজ দলের একাংশের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন পরিত্যাজ্য। এরই প্রতিফলন ঘটেছে গত সোমবার অর্থাৎ ৬ জুন অনুষ্ঠিত তাঁর সংসদীয় দলের আস্থা ভোটকে কেন্দ্র করে। এতে ৩৫৯টি দলীয় ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ২১১টি এবং তাঁর প্রতিপক্ষ পেয়েছে ১৪৮টি।
নতুনভাবে প্রাণ পাওয়া প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিজ দলকে নতুনভাবে সংগঠিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তা ছাড়া জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া তাঁর বিরূপ ভাবমূর্তি পরিবর্তনেও তিনি অত্যন্ত তৎপর হবেন বলে জানিয়েছেন। সে কারণেই অনেকে বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত এই অনাস্থা প্রস্তাবটির প্রয়োজন ছিল।
এরই মধ্যে তিনি জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় মোকাবেলায় ১৫ বিলিয়ন পাউন্ডের সহায়তা ঘোষণা করেছেন। তৎপর হয়েছেন মুদ্রাস্ফীতি রোধ করে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে। তার পাশাপাশি বিশেষভাবে নজর দিচ্ছেন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা ও নতুন নতুন বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনীর দিকে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ব্রিটিশ জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য, যোগ্যতা কিংবা প্রতিভা তাঁর রয়েছে। তবে তার অনেকখানিই নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com