পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় মাসের মধ্যে অন্যরকম ইতিহাস সৃষ্টি করেছে সাধারণ বিমা কোম্পানি মেঘনা ইন্স্যুরেন্স। টানা দাম বাড়ার পর গত সাত কার্যদিবসে টানা দাম কমার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করেছে এই কোম্পানিটি। সেই সঙ্গে সাত কার্যদিবসেই শূন্য থেকেছে ক্রয় আদেশের ঘর। লেনদেন শুরু হওয়ার দেড় মাসের মধ্যে টানা সাত কার্যদিবস ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য থাকার ঘটনা এর আগে দেশের শেয়ারবাজারে কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেনি।
প্রতিদিন সর্বনিম্ন দামে কোম্পানিটির বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির আদেশ থাকায় অনেক বিনিয়োগকারী সর্বনিম্ন দামেও কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। অথচ লেনদেন শুরু হওয়ার পর টানা ১৯ কার্যদিবস কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়ে। এর মধ্যে ১৮ কার্যদিবসেই দাম বাড়ার সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করে। এতে কোম্পানিটির ১০ টাকা দামের শেয়ার ৫৯ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত ওঠে।
সরকারি সিকিউরিটিজ ক্রয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ এবং আইপিও খরচ মেটাতে চলতি বছরের মার্চে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ১৬ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়।
আইপিওতে ১০ টাকা দামে এক কোটি ৬০ লাখ শেয়ার বিক্রি করা এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটির শেয়ার শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয় ৮ জুন। ৮ জুন থেকে ৪ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ার দাম টানা বাড়ে। ৫ জুলাই এসে পতনের মধ্যে পড়ে কোম্পানিটির শেয়ার। প্রতিদিন দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা স্পর্শ করায় কোম্পানিটির শেয়ার দাম কমে ৫০ টাকায় চলে এসেছে।
রোববার (১৭ জুলাই) দিনের সর্বনিম্ন দাম ৫০ টাকা করে কোম্পানিটির মাত্র ১৩ হাজার ২৩৭টি শেয়ার বিক্রি হয়েছে। লেনদেনের শুরুতেই দিনের সর্বনিম্ন দামে এই বিমা কোম্পানিটির কয়েক লাখ শেয়ার বিক্রির আদেশ আসে। অন্যদিকে শূন্য দেখা যায় ক্রয় আদেশের ঘর। দিনের লেনদেনের শেষ পর্যন্ত ক্রয় আদেশের ঘর শূন্য থাকে। যখন দিনের লেনদেন শেষ হয় তখনো দিনের সর্বনিম্ন দামে কোম্পানিটির ৯ লাখ ৮৮ হাজার ৪১১টি শেয়ার বিক্রির আদেশ ছিল। অর্থাৎ দিনের সর্বনিম্ন দামে বিক্রির চেষ্টা করেও বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ক্রেতা পাননি।
এদিকে, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের আইপিও অনুমোদন দেওয়ার আগেই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয়সহ একাধিক শাখা পরিদর্শন এবং বিশেষ নিরীক্ষা করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘন করে বাকিতে বিমা ব্যবসা, অতিরিক্ত কমিশন দেয়া, অবৈধ এজেন্টকে কমিশন দেয়া, প্রিমিয়াম আয়ের মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াসহ ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পায়।
মেসার্স এস এফ আহমেদ অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস দিয়ে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স বিশেষ নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিমা কোম্পানিটির ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের প্রিমিয়ামের তথ্য পর্যালোচনা করে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পায়। এ নিয়ে চলতি বছরের ১ মার্চ ‘মেঘনা ইন্স্যুরেন্সে ব্যাপক অনিয়ম’ শিরোনামে জাগো নিউজে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসে, ২০১৩ সালে কোম্পানিটি ৪৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭৯ টাকা প্রিমিয়াম আয় করে। কিন্তু আর্থিক বিবরণীতে দেখানো হয় ৩৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮ টাকা। অর্থাৎ প্রিমিয়াম ৯ কোটি ৯৪ লাখ ১১ হাজার ৭৮১ টাকা কম দেখানো হয়।
একইভাবে ২০১৪ সালে ৪৭ কোটি ২৭ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫৯ টাকা প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ৩৯ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ৬২৫ টাকা। আর ২০১৫ সালে ৫০ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার ৮৮০ টাকা প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয় ৪১ কোটি ৯৮ হাজার ৪১ হাজার ১২২ টাকা।
এই তিন বছরে (২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল) কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদনে প্রিমিয়াম আয় কম দেখিয়েছে ২৬ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭৩ টাকা। এভাবে প্রিমিয়াম আয় কম দেখানোর মাধ্যমে কোম্পানিটি ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক সরকারি কোষাগারে কম পরিশোধ করেছে।
এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩ কোটি ৭১ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩২ টাকা, ২০১৭ সালে ২ কোটি ৫৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪৫০ টাকা, ২০১৬ সালে ১ কোটি ৭০ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৬ টাকা, ২০১৫ সালে ২ কোটি ৬১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৪ টাকা, ২০১৪ সালে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮০ টাকা, ২০১৩ সালে ১ কোটি ৮০ লাখ ১ হাজার ৩১১ টাকা এবং ২০১২ সালে ৫৫ লাখ ৭ হাজার ৪১৬ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে কোম্পানিটি।
এদিকে, প্রকৃত প্রিমিয়াম পরিবর্তন করে কৃত্রিম প্রিমিয়াম দেখিয়ে ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকি এবং তহবিল তছরুপ করা হয়েছে বলে আইডিআরএ একটি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকিসহ আত্মসাৎ করার লক্ষ্যে নবাবপুর শাখায় ৯৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ, বংশাল শাখায় ৯৭ দশমিক ১১ শতাংশ, মতিঝিল শাখায় ৯৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ, মহাখালী শাখায় ৯৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং প্রিন্সিপাল শাখায় ৯৯ দশমিক ৩২ শতাংশ হ্রাস করে কোম্পানির কম্পিউটারে ডাটা বেইসে রেকর্ড করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এর ভিত্তিতে আইডিআরএ বলছে, কোম্পানির ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের ব্যবসার তথ্য প্রকৃত নয়, যা ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকিসহ তহবিল তছরুপ করার উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে হিসাব তৈরি করা হয়। কোম্পানির কৃত্রিমভাবে প্রিমিয়াম হ্রাস করার গড় হার ৯৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এটা বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানির প্রদর্শিত প্রিমিয়ামের সঙ্গে যোগ করা হলে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রকৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি হবে এবং ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
আইডিআরএ আরও বলেছে, প্রতি বছর কোম্পানিটিতে প্রকৃত প্রিমিয়ামের চেয়ে কম প্রিমিয়াম দেখিয়ে ভ্যাট ও স্ট্যাম্প শুল্ক ফাঁকি এবং তহবিল তছরুপ হয়েছে। যা বিমা পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থে বা ব্যবসা উন্নয়নের পরিপন্থি বা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি।
অন্যদিকে, প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে কমিশনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম করেছে এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি। আইডিআরএ’র পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দিলকুশা শাখা মোট ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৭২৩ টাকা প্রিমিয়াম আয় করে। এর ওপর ১৫ শতাংশ হরে কমিশন হয় ১৩ হাজার ৩৯ লাখ ৯০৮ টাকা। কিন্তু ২০১৮ সালে কোম্পানিটি সৈয়দ মমতাজুল নাসের নামের একজনকে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৯৪ টাকা কমিশন দিয়েছে, যা মোট প্রিমিয়াম আয়ের ৩৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
আইন লঙ্ঘন করে সৈয়দ মমতাজুল নাসেরকে অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া হলেও এই শাখা তার নামে এজেন্ট লা্বসেন্স দেখাতে পারেনি। যেহেতু প্রত্যেক বৈধ এজেন্টের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক, তাই লাইসেন্স না থাকায় এজেন্ট হিসেবে সৈয়দ মমতাজুল নাসের বৈধতা নেই বলে অভিমত দিয়েছে আইডিআরএ। এ ক্ষেত্রে একজন লাইসেন্স বিহীন ব্যক্তিকে কমিশন দিয়ে কোম্পানিটি বিমা আইন ২০১০ এর ৫৮ ধারা লঙ্ঘন করেছে। তাছাড়া এর মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করছে আইডিআরএ।