নওগাঁ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে দুই বছর আগে। তবে সেবাকার্যক্রম চলছে আগের সেই ১০০ শয্যার লোকবল দিয়েই। শুধু তাই নয়, এই ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালাতে যে পরিমাণ জনবল দরকার তাও নেই এখানে। এতে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সরা। হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে দ্রুত জনবল নিয়োগসহ অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানিয়েছে কর্তৃপক্ষসহ জেলাবাসী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জেলার ১১ উপজেলার বাসিন্দাদের চিকিৎসাসেবা দিতে ১৯৮৯ সালে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট নওগাঁ সদর হাসপাতাল চালু হয়। এরপর হাসপাতালটি ২০০৫ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে প্রায় ২০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আরও ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট আটতলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বর্তমানে ভবনটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পুরোনো ভবনের সঙ্গে নতুন ১৫০ শয্যা ভবন যুক্ত হয়ে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়।
এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে আগে যে জনবল দিয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম চলতো ২৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার পরও তাই রয়েছে।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে মাত্র পাঁচ টাকার টিকিটে ডাক্তার দেখাতে পারেন রোগীরা। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা পেতে দূরদূরান্ত থেকে হাসপাতালে আসেন রোগীরা। শুধু ডাক্তার দেখানোই শেষ না, এরপর বিনামূল্যে ওষুধও দেওয়া হয় রোগীদের। জেলার বাসিন্দা ছাড়াও পাশের বগুড়া জেলার আদমদীঘি ও জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থেকেও লোকজন এ হাসপাতালে সেবা নিয়ে থাকেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১০০ শয্যার হাসপাতালে উপ-পরিচালক, শিশু, মেডিসিন, ফরেনসিক, সার্জারি, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিকস, রেডিওলজি ইমেজিং, কার্ডিওলজি, নাক-কান-গলা, গাইনি অ্যান্ড অবস, প্যাথলজি, নেফ্রোলজি, নিউরোসার্জারি ও মেডিকেল অফিসারসহ মোট ৪৫ জন চিকিৎসকের স্থলে আছেন মাত্র ৩২ জন এবং নার্স ৮৬ জনের স্থলে রয়েছেন ৭৮ জন। বর্তমানে ১৩ জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে ইনডোর ও আউটডোরে সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ এবং ইনডোরে প্রায় দুই শতাধিক রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
১০০ শয্যার জন্য মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, চক্ষু, অর্থোপেডিকস ও রেডিওলজি ইমেজিং, জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনি অ্যান্ড অবস, মানসিক, প্যাথলজি ও নেফ্রোলজি, ডেন্টাল সার্জন, মেডিকেল অফিসার চক্ষু, রেডিওলজিস্ট এবং ইনডোর মেডিকেল অফিসার কার্ডিওলজি ও মেডিসিন প্রতি পদে একটি করে শূন্য রয়েছে। এছাড়া হাসপাতাল পরিচালনার জন্য ১৭৬টি মঞ্জুরি পদের বিপরীতে জনবল আছে ১২১ জন।
এদিকে, হাসপাতালের ইনডোরে ভর্তি রোগীরা চিকিৎসা পেলেও তাদের অভিযোগও কম নয়। হাসপাতাল থেকে রোগীদের ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি বাড়তি ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রোগীর স্বজনদের।
ইনডোরে রোগী দেখার পর ডাক্তার আউটডোরে গিয়ে রোগী দেখা শুরু করেন। এতে হাসপাতালের আউটডোরে সেবা নিতে আসাদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার চিকিৎসক না থাকায় হয়রানির হতে হচ্ছে সেবা নিতে আসা রোগীদেরও।
সদর উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রামের গৃহবধূ রোকসানা বেগম। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে রোববার (২১ আগস্ট) হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া জন্য এসেছিলেন। বেলা ১১টার দিকে পাঁচ টাকার টিকিট কেটে নারী চিকিৎসককে দেখানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর ডাক্তার দেখাতে পেরেছি।
রোকসানা বেগম আরও বলেন, বাইরে ডাক্তার দেখাতে কমপক্ষে ৫০০ টাকা ফি দিতে হবে। আর হাসপাতালে পাঁচ টাকায় ভালো ডাক্তার দেখানো যায়। সবার পক্ষে তো আর বাইরে ডাক্তার দেখানো সম্ভব না। আমার পরে আরও বেশ কয়েকজন সিরিয়ালে অপেক্ষায় ছিল।
মহাদেবপুর উপজেলার মাতাজিহাট এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে স্বামী কালাম হোসেনকে হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি বলেন, হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় আমার স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল থেকে সামান্য পরিমাণ ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আর বেশি ভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।
শহরের কোমাইগাড়ী মহল্লার বাসিন্দা রবিউল হাসান বলেন, নতুন ও পুরাতন মিলে আমাদের হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা। কিন্তু চিকিৎসক ও নার্স সংকট। আমরা আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসলে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। আর রোগীদের এত চাপ যে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর। ডাক্তারও তড়িঘড়ি করে দেখে ছেড়ে দেন। চিকিৎসাসেবাও ঠিকমতো আমরা পাই না।
তিনি আরও বলেন, ডাক্তারের সংখ্যা বেশি হলে রোগীদের চাপও কম হবে। শুধু জেলাবাসী না বাইরের জেলা থেকেও লোকজন এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নের দ্রুত জনবল নিয়োগসহ অবকাঠামো উন্নয়নের দাবি জানাচ্ছি।
নওগাঁ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ২৫০ শয্যা বলা হলেও ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালাতে যে পরিমাণ জনবল দরকার তাও এখানে নেই। এতে করে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সে মোতাবেক সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অনুমোদন পাওয়া গেলে ডাক্তার, সেবিকা, ওষুধ ও অবকাঠামোসহ সবকিছু দ্বিগুণ হবে। পাশাপাশি চিকিৎসাসেবার মান বাড়বে।
ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, হাসপাতাল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া কেবিনগুলো চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নওগাঁ মেডিকেল কলেজের নিজস্ব কোনো ভৌত অবকাঠামো না থাকায় হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় তাদের কার্যক্রম চলছে। এ ভবন থেকে মেডিকেল কলেজ সরানোর প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
নওগাঁ মেডিকেল কলেজে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর থেকে হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় সেটির কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
নওগাঁ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. বুলবুল হোসেন বলেন, গত দুই মাস আগে নিজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি। জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে অধিদপ্তর কাজ করছে বলে জেনেছি।