গ্রামের ভেতর ছোট্ট একটি ‘শহর’। দূরত্ব বজায় রেখে এ শহরে দাঁড়িয়ে আছে ৪-৫ তলাবিশিষ্ট দালান। আছে একটি কিন্ডারগার্টেন, শিশুদের জন্য পার্ক, শান বাঁধানো একটি পুকুর। রয়েছে পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও। ভবনের নিচে আছে মুদি-ফার্মেসিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দোকান। রয়েছে পোশাক ও ফাস্টফুডের দোকান। অতিথিদের জন্য আছে অতিথিশালা। হচ্ছে চাষাবাদও। তবে নেই কোনো হট্টগোল।
অবাক হলেও এমন একটি শহর গড়ে উঠেছে পাবনার বেড়া উপজেলার শিবপুর গ্রামে। যার নাম ‘এল কে মডেল টাউন’। প্রায় ১৫ বছর আগে দেড় একর জায়গার ওপর নিজ উদ্যোগে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন ব্যবসায়ী এস এম লিয়াকত আলী। সে সময় গ্রামের লোকজন তার কাজকে ‘পাগলামো’ মনে করতেন। তবে সময়ের ব্যবধানে এখন এ শহরের আয়তন ৯০ একর ছাড়িয়েছে।
এখানে প্লট কিংবা ফ্ল্যাটের দাম উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন মধ্যবিত্তদের হাতের নাগালে। তাই কেউ নির্মিত ভবনের ফ্ল্যাট কিনছেন আবার কিউ প্লট কিনে নিজস্ব ভবন তৈরি করছেন। এতে গ্রামে থেকেও শহুরে সুবিধা ভোগ করতে পারছেন তারা। সারাদেশে প্রতিটি ইউনিয়নেই এমন মডেল শহর গড়ার স্বপ্ন দেখেন এস এম লিয়াকত আলী। তাহলেই কৃষি জমির প্রসার হবে বলে মনে করেন তিনি।
লিয়াকত আলী জানান, ছোটবেলা থেকেই বাস করেন গ্রামে। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী এবং পরে ঠিকাদার। এসব কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই তার ভাবনায় আসতো চির চেনা গ্রামটি না ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। অপরিকল্পিতভাবে চলছে জমির ব্যবহার। যেখানে সেখানে হচ্ছে বসতঘর। গ্রামের কৃষি জমি দ্রুত অকৃষি খাতে যাচ্ছে। শুধু গ্রাম কেন সারাদেশেই তো এমনটি হচ্ছে। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন তিন যুগে এ দেশে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে। মাথায় কাজ করে একটি পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প করার। এতে কৃষিজমির ছোট হওয়ার প্রবণতা কমবে আর মানুষ নাগরিক সুবিধা পেয়ে উন্নত জীবনযাপন করবে।
ভাবনাকে বাস্তবায়নের কথা প্রথম জানান তার স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী সুফিয়া খাতুনকে। স্বামীর ইচ্ছায় সায় দেন তিনিও। এরপর ২০০৭ সালে শুরু হয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। পাবনা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাশীনাথপুর মোড়ের অদূরে শিবপুর গ্রামে নিজের দেড় একর জমিতে চারতলা বিশিষ্ট একটি ভবন তৈরির কাজ শুরু করেন। নিজের গ্রাম হওয়ায় চাাঁদবাজির খপ্পরে পড়তে হয়নি তাকে। তবে গ্রামের মানুষজন তাকে কটূক্তি করতেন। পরে তারাই সহযোগিতা করেন। এখন রিয়েল এস্টেটের পরিধি ৯০ একর ছাড়িয়েছে। ফ্ল্যাট কিংবা প্লট দুটোই বিক্রি করেন তিনি। প্রতিটি ভবনে ২২টি ইউনিট আছে।
লিয়াকত আলী বলেন, যারা আমার কাছে জমি বিক্রি করেছেন তারা ভালো দাম পেয়েছেন। এখানে এক বিঘা জমি বিক্রি করে মালিকরা ৭-৮ বিঘা কৃষি জমি কিনতে পেরেছেন। অনেক দরিদ্র এখানে এক বিঘা জমি বিক্রি করে মধ্যবিত্ত হয়েছেন। এখন নিজেকে সফল মনে হয় যখন পৌরশহর থেকেও অনেকে এখানে আসেন প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতে।
তিনি আরও বলেন, গ্রামের মানুষ অন্তত এক বিঘা বা আধাবিঘা জমির ওপর একটি বাড়ি করে। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘর তোলা হয়। কিন্তু আমার প্রকল্প এলাকায় নাগরিক সুবিধাসহ লক্ষাধিক পরিবার বাস করতে পারবে। শুধু বসবাসের হিসেব নয় এখানে পুরো প্রকল্প চালু হলে স্কুল, দোকানপাট, চিকিৎসা, পয়নিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মীসহ কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থানও হবে। এরই মধ্যে কয়েকশ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
প্রত্যেক গ্রামে বা ইউনিয়নে মডেল টাউন করা গেলে এ দেশে কৃষি জমি বাঁচানো সম্ভব জানিয়ে লিয়াকত আলী বলেন, তবে উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। সরকার অল্প সুদে ঋণ দিলে সারাদেশে আমার মতো উদ্যোক্তা বাড়তে পারে। মানুষের শহরমুখী প্রবণতাও কমবে। সারাদেশে একটি বিপ্লব ঘটতে পারে। এতে সরকারও আয়কর ও ট্যাক্স পেয়ে লাভবান হবে।
নগর পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা নগর বিশেষজ্ঞ মোশারফ হোসেন মুসা জাগো নিউজকে বলেন, বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ঘরবাড়ি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ভূমি। কৃষি জমি রক্ষায় গ্রামে এমন নগর গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
অল্প জমিতে বেশি ফসল চাষের প্রযুক্তি বা দোতলা কৃষির উদ্ভাবক অধ্যাপক জাফর সাদেক জাগো নিউজকে বলেন, সচেতনতার অভাব ও অজ্ঞতার কারণে সাধারণ মানুষ নিজেদের ইচ্ছামতো জমি ব্যবহার করছেন। শিল্পায়ন ও আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য কী ধরনের ভূমি ব্যবহার করা দরকার সে বিষয়ে ভাববার সময় এসেছে। লিয়াকত আলীর ভাবনা দেশের জন্য ভালো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাবনার অতিরিক্ত পরিচালক মো. রোকনুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, দিনে ২২০ হেক্টরের বেশি কৃষি জমি অকৃষি খাতে যাচ্ছে। বছরে কমছে ৮২ হাজার হেক্টর জমি। যা মোট জমির এক ভাগ। নির্মাণ কাজের কারণে বছরে বিলীন হচ্ছে বছরে তিন হাজার হেক্টর জমি। কৃষি জমি বাঁচাতে লিয়াকত আলী প্রশংসাযোগ্য কাজ করেছেন।